মানুষের মতো বাঁচতে চাই
রানী রাজাকে বলল, রাজা, তোমার বড্ড বেশী ঘুম। তুমি দিনেও ঘুমোও, রাতেও ঘুমোও। এত ঘুম কি ভালো? এত ঘুম ঘুমোলে রাজ্য চালাবে কি করে?
রাজা বলল, সে কি, বেশী ঘুমোলাম আবার কখন? সারা দিনে রাতে তো চব্বিশ ঘণ্টা। তার মধ্যে এ কাজ আছে, ও কাজ আছে, নাওয়া আছে, খাওয়া আছে, আরও কত কি আছে। রাজার কাজের কি কোনো শেষ আছে? তার ওপর যখন তখন তোমার এই ঘ্যান-ঘ্যানানি, প্যান-প্যানানি। এর মধ্যে কি আর ঘুমোবার যো আছে! মনের সাধ মিটিয়ে ঘুমোতে না পেরে আমার গায়ে আর জুত লাগছে না, রোগাও হয়ে যাচ্ছি দিন দিন।
রানী অবাক হয়ে বলল, শোন কথা! রোগা না ছাই, তুমি তো দিব্যি মুটিয়ে চলেছ।
রাজা বলল, তোমার ওই এক কথা! মোটা হয়ে যাচ্ছি, মোটা হয়ে যাচ্ছি। আর কোনো কথা জানো না। বেশ, মোটা হয়েছি তো হয়েছি, এখন তুমি করতে চাও কি?
রানী উত্তর করল, বা রে, আমি আবার কি করতে চাইব? আমার করবার কি আছে? আমি বলছি তোমার ভালোর জন্যই। যা হয়েছে হয়েছে, আর বেশী মোটা হোয়ো না। এমনিতেই তো তুমি সারা খাটটা জুড়ে থাকো, আমি কোনো মতে এক পাশে পড়ে থাকি। এরপর আরও যদি মোটা হও তখন আমার উপায়টা হবে কি?
রাজা এ কথা শুনে আগুন হয়ে উঠল। মোটা বললে রাজা বড় চটে যায়। সে বলল, তোমার একটু আক্কেল পছন্দ নেই। সবাই বলে আমি রোগা হয়ে যাচ্ছি, আর তুমি বল কি না আমি মোটা!
রানী বলল, বলব না? আমি কি তোমার কর্মচারী না প্রজা যে, তোমার ভয়ে তোমার মন রেখে কথা বলব? তুমি রাজা হতে পার, কিন্তু আমি তো রানী। রানী কখনও বাজে কথা বলে না।
এই নিয়ে কথা কাটাকাটি, শেষে তুমুল ঝগড়া। রাজা এক কথা বললে রানী দশ কথা শুনিয়ে দেয়। রানী রাজার চেয়ে ছোট কিসে? বরং এক কাঠি উপরে।
রাজা ঢাল-তলোয়ার আর তীর-ধনুক নিয়ে যুদ্ধ করতে জানে, কিন্তু মেয়েমানুষের সঙ্গে বিশেষ করে রানীর মতো তেজী মেয়েমানুুষের সঙ্গে ঝগড়া করে কুলিয়ে উঠতে পারে না।
রানীর কাছে এ ভাবে নাস্তানাবুদ হয়ে রাজার সংসারে ঘেন্না ধরে গেল। তার মনে হলো, মা যার ঘরে নেই, আর বউ যার ঝগড়াটে তার ঘরও যা বনও তা। রইল পড়ে রাজত্ব আর ঘর সংসার, কাউকে কোনো কথা না বলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল রাজা। গেল তো গেল, আর ফিরল না। কোথায় গেল তার কোনই উদ্দেশ পাওয়া গেল না।
রাজ্যশুদ্ধ হাহাকার পড়ে গেল, আহা আমাদের এমন ভালো রাজা, সে রাজা আমাদের কোথায় চলে গেল? আসল কথাটা আর কেউ তো জানে না, এক জানে রানী। সে কেঁদেকেটে অস্থির। কেনই বা এই সামান্য কথা নিয়ে ঝগড়া করতে গিয়েছিল। মনের দুঃখে আহার নিন্দ্রা ত্যাগ করার অবস্থা। দলে দলে লোক ছুটল রাজার খোঁজ করতে। কিন্তু রাজার কোনো খোঁজই পাওয়া গেল না।
রাজাকে সবাই ভালোবাসত। তার অভাবে কারো মনে আর সুখ নেই। আস্তাবলে রাজার বড় আদরের ঘোড়াটা রাজা চলে যাবার পর থেকে একমুঠো দানা দাঁতে কাটতে চায় না। না খেয়ে মর-মর অবস্থা। রাজপুরীতে রাজার নিজের হাতে পোষা শুকপাখি মাথাও তোলে না, ডাকাডাকিও করে না, খেতেও চায় না। এ ভাবে কদিন আর বাঁচবে! রানী আদেশ দিল, দাও, ওই ঘোড়াকে ছেড়ে দাও, আর ওই শুকপাখিকে উড়িয়ে দাও।
যাবার সময় রানী ঘোড়ার গায়ে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, যাও ঘোড়া, দেখ রাজাকে খুঁজে আনতে পার কিনা। ঘোড়া সব কথা বুঝতে পারে, শুধু কথা বলতে পারে না। তার দুচোখ বেয়ে জল পড়তে লাগল।
শুকপাখিকে চুমু খেয়ে রানী বলল, শুক, প্রাণের শুক, যে কথা কারু কাছে বলতে পারি না, সে কথা তোমার কাছে বলি। আমারই দোষ। আমি ঝগড়া করেছিলাম, সেইজন্যই রাজা রাগ করে ঘর ছেড়ে চলে গেছে।
সকল পাখির সেরা পাখি তুমি শুকপাখি, তুমি দেশ দেশান্তরের খবর রাখ, দেখ দেখি তুমি রাজাকে ফিরিয়ে আনতে পার কিনা। যদি রাজাকে নিয়ে আসতে না পার, এ প্রাণ আমি আর রাখব না।
শুকপাখি কথা বলতে পারে। সে মুুখ ফুটে বলল মা, অমন কোরো না। আমার চোখকে কোন কিছুই ফাঁকি দিতে পারে না। আমি যেমন করেই হোক রাজাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসব।
শুকপাখির কথা শুনে রানীর মুখে এই প্রথম একটু হাসি দেখা দিল। ঘোড়া আর শুকপাখি একই সঙ্গে যাত্রা করল, রাজাকে ফিরিয়ে আনতে। এত মানুষ এত চেষ্টা করেও যা পারল না, সামান্য পশু-পাখি, ওরা কি তা পারবে? রানীর ভেতর থেকে কে যেন বলে উঠল, পারবে, ওরা পারবে।
এদিকে রাজা রাজপুরী ছেড়ে চলতে চলতে চলতে চলতে নিজের রাজ্য ছাড়িয়ে, আরও কত রাজার রাজ্য ছাড়িয়ে শেষে এক অজানা দেশে এসে পড়ল। রাগের মুখে চলে এসেছে, তখন কি আর হুঁশ ছিল, বেশী করে টাকা-পয়সাও সঙ্গে করে নিয়ে আসে নি। যেটুকু সম্বল ছিল, তা কিছু দিনের মধ্যেই ফুরিয়ে গেল। এখন কি আর করে, এ বাড়ি যায়, ও বাড়ি যায়, লোকের বাড়িতে অতিথি হয়ে ওঠে। কেউ কেউ আদর করে খাওয়ায়। কিন্তু সব মানুষ তো সমান নয়। মাঝে মাঝে উপোস করেও কাটাতে হয়।
রাজা মানুষ, না খেয়ে থাকার অভ্যাস তো নেই। ক্ষিদের জ্বালায় বড় কষ্ট হয়। এ দিকে রাগের গরমটাও কমে এসেছে। এখন বুঝতে পারছে, এ ভাবে চলে আসাটা ঠিক হয় নি। রাজ্যের মধ্যেই সে রাজা, রাজ্যের হর্তাকর্তা বিধাতা। কিন্তু রাজ্যের বাইরে তো তার এক পয়সা দামও নেই। এখানে কে তাকে চিরকাল পুষবে? আর হাতের কাজ তো কোনোদিন করে নি। কেমন করে রোজগার করে পেট চালাতে হয়, তাও তো তার জানা নেই।
মাঝে মাঝে মনে হয়, যাই ফিরে ঘরে। কিন্তু বড় লজ্জা লাগে, ফিরে গিয়ে কি বলবে? আর যাকে যাই বলে বোঝাক না কেন, রানীকে তো আর কোনো কিছু বলে ফাঁকি দেওয়া যাবে না। এখন ফিরে গেলে রানী নিশ্চয়ই টিটকারী দেবে, আর এই নিয়ে হাসাহাসি করবে। এ কথা মনে হলেই তখন বাড়ি ফেরার ইচ্ছাটা মন থেকে দূর হয়ে যায়। কিন্তু এ ভাবেই বা ক’দিন চলবে।
একদিন পথ দিয়ে চলতে চলতে হঠাৎ ক’জন লোকের সাথে মুখোমুখি দেখা। সে দেশের রাজার কর্মচারী তারা। তারা কাজের লোক খোঁজ করে বেড়াচ্ছিল। রাজার মায়ের নামে এক দীঘি কাটানো হবে। বিরাট দীঘি। সেই দীঘি কাটবার জন্য হাজার হাজার লোকের দরকার। ওরা রাজাকে দেখে জিজ্ঞেস করল, এই ব্যাটা, তুই কাজ করিস?
রাজা সত্যি কথাই বলল। বলল আমি কোনো কাজ করি না।
কোনো কাজ করিস না! তবে খাওয়া জোটে কেমন করে? চুরি করিস?
রাজা বলল, না আমি চুরি করি না, আমি এ বাড়ি ও বাড়ি খাই।
ও, তুই তবে ভিখারী?
ভিখারী বলাতে রাজার মনে ঘা লাগল। সে তেজ দেখিয়ে বলে উঠল, কক্ষনো না। আমি ভিখারী হব কেন? আমি এক দেশের রাজা।
ওরা রাজার কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠল। ওদের সর্দার বলল, ধর তো ব্যাটা রাজাকে। ওর রাজাগিরি বার করছি। জোয়ান মর্দা ব্যাটা কাজকর্ম করবে না, শুধু পরের উপর খাবে।
একজন ওর হাতটা দেখে
লগইন করুন? লগইন করুন
Leave A Comment
Don’t worry ! Your email address will not be published. Required fields are marked (*).
Comments